ভুট্টা বীজ বপন পদ্ধতি | ভুট্টা চাষ পদ্ধতি ও ফলন
ভুট্টা চাষ পদ্ধতি ও ফলন
বাংলাদেশে ভুট্টা চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এটি শুধু মানুষের খাদ্য হিসেবেই নয়, পশুখাদ্য ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয়। সঠিক সময়ে জমি প্রস্তুত, বপন, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা করলে ভুট্টার ফলন অনেক বেড়ে যায়। এই আর্টিকেলে সহজ ভাষায় ভুট্টা চাষের ধাপ, পরিচর্যা, ফলন বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণের সম্পূর্ণ গাইড তুলে ধরা হলো।
উপযোগী জলবায়ু ও মাটি
ভুট্টা উষ্ণ আবহাওয়ার ফসল। তাপমাত্রা ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ভুট্টার বৃদ্ধি ভালো হয়। গভীর দোঁআশ বা পলি দোঁআশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। জমির pH ৫.৮–৭.২ এর মধ্যে হলে সর্বোত্তম ফলন পাওয়া যায়। পানি জমে থাকে এমন জমিতে ভুট্টা চাষ করা উচিত নয়।
ভুট্টার জাত নির্বাচন
চাষের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভুট্টার জাত নির্বাচন করা জরুরি।
শস্য উৎপাদনের জন্য হাইব্রিড জাত সবচেয়ে ভালো।
মিষ্টি ভুট্টা মূলত কচি অবস্থায় খাওয়ার জন্য উপযোগী।
পশুখাদ্যের জন্য সাইলেজ জাত ব্যবহার করা হয়, যা বেশি সবুজ ভর উৎপাদন করে।
জাত নির্বাচন করার সময় মানসম্মত ও অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা উচিত।
জমি প্রস্তুতি
জমি ২–৩ বার চাষ দিয়ে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। জৈব সার হিসেবে প্রতি হেক্টরে ৩–৫ টন গোবর প্রয়োগ করা ভালো। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
বপনের সময় ও পদ্ধতি
বাংলাদেশে ভুট্টা সাধারণত রবি মৌসুমে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) বপন করা হয়। খরিফ মৌসুমেও চাষ করা যায় তবে অতিবৃষ্টি এড়ানো দরকার।
বীজের পরিমাণ: হেক্টরপ্রতি ১৮–২৫ কেজি।
সারির দূরত্ব: ৬০–৭০ সেমি।
গাছের দূরত্ব: ২০–২৫ সেমি।
বপনের গভীরতা: ৩–৫ সেমি।
বপনের পর হালকা সেচ দিলে অঙ্কুরোদ্গম ভালো হয়।
সার ব্যবস্থাপনা
ভুট্টার ভালো ফলনের জন্য সুষম সার ব্যবহার করা জরুরি। প্রতি হেক্টরে সাধারণত নাইট্রোজেন ১৫০–২০০ কেজি, ফসফরাস ৬০–৮০ কেজি, পটাশ ৪০–৬০ কেজি, সালফার ১৫–২০ কেজি ও বোরন ১–২ কেজি প্রয়োজন।
বপনের আগে সমস্ত ফসফরাস, পটাশ, সালফার, বোরন এবং নাইট্রোজেনের এক-চতুর্থাংশ জমিতে দিতে হবে।
বাকি নাইট্রোজেন দুই ধাপে দিতে হবে: একবার ২০–২৫ দিন পর এবং আরেকবার ৪০–৪৫ দিন পর।
সেচ ব্যবস্থাপনা
- ভুট্টার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোতে সেচ খুব প্রয়োজনীয়।
- অঙ্কুরোদ্গম
- হাঁটু-উচ্চতা পর্যায়
- ফুল আসার সময় (ট্যাসেল)
- দানা ভরাট সময়
এই পর্যায়গুলোতে জমিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। তবে জমিতে পানি জমে থাকা উচিত নয়।
আগাছা, পোকা ও রোগবালাই দমন
আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য বপনের ২০–২৫ দিন ও ৪০–৪৫ দিন পর নিড়ানি দিতে হয়।
ফল আর্মিওয়ার্ম, স্টেম বোরার ও এফিড ভুট্টার প্রধান ক্ষতিকর পোকা। নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার এবং প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ভুট্টার রোগের মধ্যে পাতাঝলসা, ডাউনিমিলডিউ উল্লেখযোগ্য। বীজ শোধন, ফসল পর্যায়ক্রম ও প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক প্রয়োগে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফলন বাড়ানোর উপায়
- উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার।
- সঠিক সময়ে বপন।
- নির্ধারিত সারি ও গাছের দূরত্ব বজায় রাখা।
- সময়মতো সার ও সেচ প্রয়োগ।
- আগাছা ও রোগবালাই নিয়মিত দমন।
- মাঠ পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়া।
সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ভুট্টা সংগ্রহের সময় দানা শক্ত ও খোসা শুকিয়ে গেলে বুঝতে হবে ফসল তোলার সময় হয়েছে। দানা শুকিয়ে আর্দ্রতা ১৩–১৪% এ নামাতে হবে। এরপর বস্তায় ভরে শুষ্ক, ঠান্ডা ও ইঁদুরমুক্ত গুদামে রাখতে হবে। মিষ্টি ভুট্টা সাধারণত ফুল আসার ১৮–২৪ দিন পর কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়।
ফলন ও অর্থনৈতিক দিক
ভালো ব্যবস্থাপনায় প্রতি হেক্টরে হাইব্রিড ভুট্টা ৮–১২ টন শস্য দিতে পারে। মিষ্টি ভুট্টা থেকে ৬–৮ টন এবং সাইলেজ জাত থেকে ৪০–৫০ টন সবুজ ভর পাওয়া সম্ভব। খরচ-সাপেক্ষ হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনায় ভুট্টা চাষ লাভজনক হয়।
সাধারণ ভুল যা এড়াতে হবে
অতিরিক্ত ঘন বপন করা।
একবারে সব সার প্রয়োগ করা।
জমিতে পানি জমে রাখা।
দেরিতে রোগ-পোকা শনাক্ত করা।
দেরিতে ফসল সংগ্রহ ও আর্দ্র অবস্থায় সংরক্ষণ।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. ভুট্টা বপনের সেরা সময় কখন?
রবি মৌসুমে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টি সবচেয়ে ভালো।
২. ভুট্টার জন্য আদর্শ সারি ও গাছের দূরত্ব কত?
সারি ৬০–৭০ সেমি এবং গাছের দূরত্ব ২০–২৫ সেমি রাখা উচিত।
৩. ভুট্টার ভালো ফলনের জন্য কী পরিমাণ সার প্রয়োজন?
প্রতি হেক্টরে নাইট্রোজেন ১৫০–২০০ কেজি, ফসফরাস ৬০–৮০ কেজি, পটাশ ৪০–৬০ কেজি, সালফার ১৫–২০ কেজি এবং বোরন ১–২ কেজি প্রয়োজন।
৪. ভুট্টার কোন পর্যায়ে সেচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
অঙ্কুরোদ্গম, হাঁটু-উচ্চতা, ট্যাসেল এবং দানা ভরাট পর্যায়ে সেচ অপরিহার্য।
৫. ভুট্টার প্রধান পোকা ও রোগ কিভাবে দমন করা যায়?
ফল আর্মিওয়ার্ম, স্টেম বোরার ও এফিড নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও ফেরোমন ট্র্যাপের মাধ্যমে দমন করা যায়। পাতাঝলসা ও ডাউনিমিলডিউ প্রতিরোধে বীজ শোধন ও প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়।
