বল সুন্দরী বরই চাষ পদ্ধতি | বল সুন্দরী কুল চাষে কৃষকের সাফল্য
বল সুন্দরী বরই চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে বরই চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর মধ্যে বল সুন্দরী বরই বর্তমানে কৃষকদের কাছে লাভজনক একটি জাত। স্বল্প সময়ে অধিক ফলন, বাজারে ভালো চাহিদা এবং তুলনামূলক কম খরচে উৎপাদন হওয়ার কারণে এই জাতটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আজ আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো বল সুন্দরী বরই চাষ পদ্ধতি নিয়ে।
বল সুন্দরী বরই কী?
বল সুন্দরী বরই একটি উন্নত জাতের বরই। এটি আকারে মাঝারি থেকে বড়, গোলাকার এবং লালচে-হলুদ বর্ণের হয়। স্বাদ মিষ্টি এবং টক-মিষ্টি হওয়ায় ভোক্তাদের মধ্যে এর চাহিদা বেশি। এর ফলন ক্ষমতা ও গুণমানের জন্য বাজারে দামও তুলনামূলক বেশি মেলে।
বল সুন্দরী বরই চাষের জন্য উপযুক্ত জমি ও জলবায়ু
এই জাতের বরই চাষের জন্য দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত।
পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
শুষ্ক আবহাওয়া ও পর্যাপ্ত সূর্যালোক বল সুন্দরী বরই চাষের জন্য দরকার।
মধ্যম উষ্ণতা এবং কম বৃষ্টিপাতের পরিবেশ বরই গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী।
জমি প্রস্তুতি
প্রথমে জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে।
গর্ত তৈরি করতে হবে ১ মিটার দৈর্ঘ্য, ১ মিটার প্রস্থ ও ১ মিটার গভীরতায়।
প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে নিতে হবে।
চারা রোপণের আগে গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে ১৫-২০ দিন খোলা রাখতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি
সাধারণত বরই চারা বর্ষার শেষে বা শীতকালে (জুলাই-ডিসেম্বর) রোপণ করা যায়।
৫-৬ মিটার দূরত্বে একটি করে গর্তে চারা রোপণ করতে হবে।
রোপণের পর পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
বল সুন্দরী বরই চাষে সঠিক সার ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম বছর গাছে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম এমওপি দিতে হবে।
দ্বিতীয় বছরে এই পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে।
তৃতীয় বছর থেকে পূর্ণ ডোজ সার দিতে হবে।
সার গাছের গোড়া থেকে ৫০-৬০ সেমি দূরে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও আগাছা দমন
বরই গাছে বেশি পানি দরকার হয় না। তবে ফুল ও ফল ধরার সময় ১৫-২০ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
গাছের গোড়ায় আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
আগাছা দমনের জন্য আলগা মাটি করে মালচিং করা যেতে পারে।
ছাঁটাই ও গাছ পরিচর্যা
ফল সংগ্রহ শেষে গাছের শুকনা ডাল, রোগাক্রান্ত ডাল এবং অতিরিক্ত শাখা ছেঁটে দিতে হবে।
ছাঁটাই করলে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং ফলন বাড়ে।
গাছে ফুল আসার সময় অযথা শাখা-প্রশাখা রাখলে ফলের আকার ছোট হয়। তাই গাছকে খোলা রাখতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন
বল সুন্দরী বরই চাষে কিছু সাধারণ রোগ ও পোকামাকড় দেখা যায়, যেমন:
ফল ছিদ্রকারী পোকা → ফলের ভেতরে ঢুকে নষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে লাল ফাঁদ ব্যবহার ও অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
পাতা ঝলসানো রোগ → আক্রান্ত পাতা ঝরে যায়। কপার অক্সিক্লোরাইড স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যায়।
মাকড়সা পোকা → পাতায় জাল বুনে শোষণ করে। সালফার জাতীয় ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহ ও ফলন
সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়।
একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে ৬০-৮০ কেজি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।
ফল সংগ্রহের সময় সাবধানে তুলতে হবে যাতে ডাল ভেঙে না যায়।
বাজারজাতকরণ
বল সুন্দরী বরই এর চাহিদা শহর ও গ্রামে সমান।
ফল বড়, আকর্ষণীয় ও মিষ্টি হওয়ায় বাজারে সহজেই বিক্রি হয়।
সরাসরি পাইকারি বাজার, সুপারশপ বা অনলাইন মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে বিক্রি করা যায়।
সঠিক প্যাকেজিং করলে দূরবর্তী বাজারেও পাঠানো সম্ভব।
বল সুন্দরী বরই চাষের উপকারিতা
- স্বল্প খরচে বেশি লাভ।
- তুলনামূলক কম পরিচর্যা লাগে।
- স্বল্প সময়ে ফলন পাওয়া যায়।
- বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়।
- কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক।
৫টি এফএকিউ (FAQ)
প্রশ্ন ১: বল সুন্দরী বরই চাষের জন্য কোন মাটি ভালো?
উত্তর: দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত।
প্রশ্ন ২: বল সুন্দরী বরই কোন সময়ে চাষ করা যায়?
উত্তর: বর্ষার শেষ ও শীতকালে (জুলাই-ডিসেম্বর)।
প্রশ্ন ৩: একটি গাছ থেকে কত ফলন পাওয়া যায়?
উত্তর: পূর্ণবয়স্ক গাছে ৬০-৮০ কেজি পর্যন্ত ফলন হয়।
প্রশ্ন ৪: বল সুন্দরী বরই রোগ দমন কিভাবে করা যায়?
উত্তর: ফল ছিদ্রকারী পোকা, পাতা ঝলসানো ও মাকড়সা নিয়ন্ত্রণে অনুমোদিত কীটনাশক ও সঠিক পরিচর্যা দরকার।
প্রশ্ন ৫: বল সুন্দরী বরই বাজারজাতকরণে কীভাবে বেশি লাভ করা যায়?
উত্তর: সঠিক সময়ে সংগ্রহ, আকর্ষণীয় প্যাকেজিং ও অনলাইন/সুপারশপে বিক্রির মাধ্যমে বেশি লাভ সম্ভব।
